|| Biography Of Vasco Da Gama, ভাস্কো দা গামা জীবনী
Vasco Da Gam
জ্ঞান বিজ্ঞান অন্বেষণে সবসময় উদ্যত ইউরোপীয়দের কাছে ইউরোপের বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার একমাত্র সূত্র ছিল পর্যটকদের বিবরণ। এই বিবরণের ওপর ভিত্তি করেই তৎকালীন ভৌগোলিকরা নির্মাণ করতেন মানচিত্র। টলেমি থেকে মার্কেটর- মানচিত্রের বিবর্তন ঘটেছে ভৌগোলিক অভিযানের ওপর ভিত্তি করেই। এই ভৌগোলিক অভিযানে ইউরোপীয়দের পাখির চোখ ছিল এশিয়া তথা ভারতবর্ষ। এশিয়া বৃত্তান্তের সর্বগুরুত্বপূর্ণ মার্কোপোলোর বিবরণ পুঁথি আকারে পড়েছিলেন পর্তুগালের যুবরাজ হেনরি। তারপর থেকে ভৌগোলিক মানচিত্র নির্মাণ ও ভৌগোলিক অভিযান চালাতে তাঁর মধ্যে উৎসাহ তৈরী হয়।

কিন্তু এই ভৌগোলিক অভিযানের পেছনে প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক। সূতিবস্ত্র, সিল্ক ও মশলার জন্য সমগ্র ইউরোপ নির্ভর করত এশিয়া তথা তৎকালীন ভারতবর্ষের ওপর। আর এশিয়া থেকে এইসব পণ্য নিয়ে এসে ইউরোপের বাজার দখল করত আরব বণিকরা। এছাড়া কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর অবাধে ইসলাম ধর্ম ইউরোপে প্রবেশ করতে থাকে। ফলে ইউরোপে পুনরায় মধ্যুযগীয় ক্রুসেডের যেমন প্রয়োজন অনুভূত হয়, তেমন ইউরোপের বাইরে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করে ইসলামের মোকাবিলা করাও ধর্মপ্রাণ ইউরোপীয়দের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। পর্তুগালের রাজা প্রথম জনের ছেলে যুবরাজ ও নাবিক হেনরি এই উদ্দেশ্যেই পর্তুগালের ভৌগোলিক নৌঅভিযান শুরু করান।

ভারত অভিযান:-

১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জুলাই পর্তুগালের লিসবন বন্দর থেকে ভারত যাওয়ার সামুদ্রিক পথ আবিষ্কার ও গোলমরিচের বাণিজ্যকে সরাসরি করার উদ্দেশ্যে ৩০ বছর বয়সী পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামার নেতৃত্বে নৌবহর রওনা দেয়। গামার পরিকল্পনা ছিল, প্রথমে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে দক্ষিণে যাবেন, তারপর ঘুরবেন বাঁয়ে, আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে পুবের পথ ধরবেন। তারপর রওনা হবেন উত্তরে। সবশেষে ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে পুবের পথ ধরবেন।

এই অভিযানের ১০ বছর আগে একদল পর্তুগীজ নাবিক আফ্রিকার দক্ষিণের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন। আসল রহস্য লুকিয়েছিল আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তের অন্তরীপ গুলোতে, যাদের বর্তমানে কেপ অন্তরীপ বলা হয়। গামা ভেবেছিলেন ওখানেই ভারত কিনা! আবার এও ভেবেছিলেন আফ্রিকার দক্ষিণপ্রান্ত থেকে পূর্ব উপকূল ধরে উত্তরে আরব সাগর পর্যন্ত যাওয়ার কোনো পথ পাওয়া যাবে কিনা? কারণ সেখানেই আরব বণিকরা সমুদ্রে বেশি ঘোরাঘুরি করে, ভারতের অবস্থান হয়ত সেখানেই!

লিসবন ছেড়ে আসার এক সপ্তাহ পর গামার নৌবহর সবে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ও ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের মাঝে এসে পৌঁছোয়। বর্তমান মরক্কোর কাছে এই সমুদ্র উপকূল। ওখানে নোঙর করে কিছুদিন বিশ্রাম নেয় জাহাজগুলো। কিন্তু যে রাতে তাঁরা আবার যাত্রা শুরু করেন; ঘন কুয়াশার কারণে বহরের জাহাজগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিক হারায়। তবে প্রটোকল অনুযায়ী পথ হারালে পর প্রত্যেকটা জাহাজ ১৫° দক্ষিণে কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করতে থাকে। ২৬শে জুলাই সেখানে তারা একজোট হয়।

গামার পূর্ববর্তী বহু পর্তুগীজ নাবিক আফ্রিকা সফর করেছিলেন। তাদের যাত্রাপথকে এক্ষেত্রে অনুসরণ না করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ৩রা আগস্ট কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জ ছেড়ে রওনা দেয় বহর। তবে আফ্রিকার উপকূল ধরে নয় বরং মাঝ সমুদ্র দিয়ে। 

মাঝ সমুদ্রে টানা ৯৩ দিন কাটানোর পর ৪ঠা নভেম্বর দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার ন্যাড়া উপকূল পৌঁছোয় নৌবহর। বার্তেলামিও দিয়াজ আবিষ্কৃত ঝড়ের অন্তরীপ বা উত্তমাশা অন্তরীপ যার বর্তমান নাম Cape of Good Hope ঘুরে উপকূলের শেষাংশ পেরোতে খুব ঝুঁকি পোহাতে হয় তাঁদের। এরপর তারা সেন্ট হেলেনা বে তে নোঙর করে বর্তমান সাউথ আফ্রিকার মাটিতে বিশ্রাম নেন। ইতিমধ্যে গামা খোলা সমুদ্রে একটানা দীর্ঘপথ যাওয়ার রেকর্ড করে ফেলেন।
১৬ই নভেম্বর আবার রওনা হয় নৌবহর। পথে অফ্রিকার সর্বদক্ষিণ প্রান্ত মোসেল বে তে কিছুদিনের বিশ্রাম নেওয়া হয়। এই মোসেল বে তেই আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের জল পরস্পর মিলিত হয়। ৭ই ডিসেম্বর ফের অভিযান শুরু হয়। ১০ই ডিসেম্বর বার্তেলামিও ডিয়াজের পোঁতা পাথরের খুঁটি পার করে এগোতে থাকে নৌবহর। দিয়াজের পোঁতা ঐ খুঁটি ছিল ইউরোপীয়দের সর্বাধিক অতিক্রান্ত দূরত্ব। গামা এই খুঁটি পেরিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন। কিন্তু এই সাফল্যের সাথেই গামার সামনে চলে আসে নতুন চ্যালেঞ্জ। কারণ এরপর যাত্রাপথের কোনো মানচিত্র বা বিবরণ শুধু গামা নয়, বরং কোনো ইউরোপীয়র আর জানা ছিল না।

২৫শে ডিসেম্বর আফ্রিকার দক্ষিণ পূর্ব উপকূল ধরে বিপজ্জনক মোজাম্বিক স্রোতকে জুঝে নৌবহর মাদাগাস্কার কাছে গ্রেট ফিশ রিভারের উত্তর দিকে এগোয়। এই সময় যে ভূখণ্ড তাঁরা পার হন তার নাম রাখা হয় নেটল। এ নাম আজও অপরিবর্তিত। দুঃসাহসিক এই অভিযানে গামার নৌবহরের অনেক সদস্য স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হন ও মারা যান।
১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে অসুস্থ নাবিকদের শুশ্রুষার জন‍্য ডাঙার হদিশ মেলে। এই ডাঙা ছিল কুয়েলিমেন নদীর মোহনা অঞ্চলে যা মোজাম্বিকের অংশ। এখানে তাঁরা ৫ দিন বিশ্রাম নেন। এই অঞ্চল ছিল আরব প্রভাবাধীন। গামা বুঝতে পারেন তিনি পূর্ব আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত অংশে পৌঁছে গেছেন। এইসময় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মুসলিম সভ্যতা বলতে ছোটো ছোটো সালতানাতের (সাম্রাজ্য) সমষ্টিকে বোঝাত।
সামনের পথ গামার অজানা হওয়ায় এবং ভারতের কাছে এসেও যাতে তাঁকে ব‍্যর্থ না হতে হয়, এর জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে যে কটা বন্দর পড়বে প্রতিটাতে তিনি নোঙর করে বিকিকিনি করবেন এবং অপেক্ষা করবেন একজন স্থানীয় দক্ষ নাবিকের, যে তাঁকে ভারত পৌঁছনোর সঠিক দিক নির্দেশ করতে পারবে। কিন্তু দক্ষ নাবিক না মেলায় যাহোক করে মোম্বাসা (কেনিয়া) পর্যন্ত পৌঁছয় নৌবহর।

ইতিমধ্যে গামার অভিযানকে ব্যর্থ করতে তৎপর হয়ে ওঠে আরবরা। যাত্রাপথে মাঝে মধ্যেই স্থানীয় আরব সুলতানদের সাথে বিরোধ বাঁধতে থাকে নৌবহরের। বড় বিপদের আশঙ্কা দূর করতে তাই গামা পথ পরিবর্তন করে মালিন্দির দিকে রওনা হন। মালিন্দির সুলতানের থেকে দক্ষ নাবিক মালিদকে পেয়ে তার দেখানো পথে গামা যাত্রা শুরু করেন ভারতের উদ্দেশ্যে।

১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে এপ্রিল গামার নৌবহর মালিন্দি বন্দর ছেড়ে রওনা হয় এবং আজকের দিনে অর্থাৎ ২০ মে ভারতের দক্ষিণে মালাবার উপকূলে কালিকুট বন্দরে পৌঁছোয়। আপাতদৃষ্টিতে কালিকুট নগরীতে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামার পা রাখার মাধ্যমে মূলত ভারতের সাথে পশ্চিমী দুনিয়ার সরাসরি বাণিজ্য শুরু হয় কিন্তু পরবর্তীকালে বণিকের মানদন্ড ভারতবর্ষ শাসনের রাজদন্ডে পরিণত হয়। ২৯শে আগস্ট গামা দেশে ফেরার জন্য রওনা দেন। পরের বছর ১০ই জুলাই তিনি পৌঁছন লিসবনে।

Estado Portuguesa da Índia:

সমুদ্রজয়ী জাতি পর্তুগীজদের প্রথম লক্ষ্য ছিল বাণিজ‍্যের ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের নেশায় ভারত যাওয়ার পথ আবিষ্কার করা। এবার পর্তুগীজদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় গামার আবিষ্কৃত পথে ভারত জয় তথা ভারতে পর্তুগীজ উপনিবেশ গড়ে তুলে ভারতকে শক্ত মুঠোয় পোরা।

গামার দেখানো পথে আরো বড় নৌবহর পাঠান পর্তুগালের নতুন রাজা ম‍্যানিল। কিন্তু বারবার নাবিকরা পথ ভুল করে। তবে এই ভুলের প্রাপ্তি হিসেবে নাবিকরা আবিষ্কার করতে থাকে আরো নতুন নতুন ভূখণ্ড। যেমন - ব্রাজিল তথা দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ, মাদাগাস্কার, নেপোলিয়ান খ্যাত সেন্ট হেলেনা দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি।

১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ম্যানিল, ফ্রান্সিস্কো-দা-আলমিদাকে ভারতে পর্তুগালের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান। তিনি কোচিনকে আরো শক্তিশালী পর্তুগীজ ঘাঁটিতে পরিণত করেন। ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরের সকল পর্তুগীজ অভিযান এই কোচিন থেকেই পরিচালিত হত। এরপর ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে আসেন পর্তুগীজ সেনাপতি আফানসো-দা-আলবুকুয়ের্ক। তিনিই মালাবার উপকূলে গোয়া বন্দর দখল করেন এবং গোয়াকে ভারতের প্রধান পর্তুগীজ ঘাঁটিতে পরিণত করেন। কিন্তু ক্রমশ পর্তুগীজ উপনিবেশ গুলোতে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেতে থাকলে রাজা পর্তুগালের বিশ্বস্ত নাবিক ভাস্কো-দা-গামাকে ভারতের পর্তুগীজ ভাইসরয়ের পদে অধিষ্ঠিত করেন। গামা ১৫২৪ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় ভারতে আসেন এবং ২৪শে ডিসেম্বর ভারতের মাটিতেই তিনি মারা যান। তাঁর মরদেহ লিসবনের সাও জেরেনিমো গির্জায় সমাধিত রয়েছে।

গামার মৃত্যুর পর ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্টিন এফেনসো-দা-মেলো হুগলীর ব্যাণ্ডেলে পর্তুগীজ উপনিবেশ গড়ে তোলেন। ভারতে সমগ্র পর্তুগীজ উপনিবেশ অঞ্চলকে বলা হত Estado Portuguesa da Índia.

পর্তুগীজরা এরপর পূর্ববঙ্গের প্রধান বন্দর চট্টোগ্রামে নিজেদের উপনিবেশ গড়তে সচেষ্ট হয়। একে বলা হত Porto the Gande Bengla. বঙ্গোপসাগরের এই বাণিজ্যিক অঞ্চলটায় ইউরোপীয় হিসেবে পর্তুগীজরাই প্রথম উপনিবেশিক ছিটমহল স্থাপন করে। এরপর কালের নিয়মে যথাক্রমে ফরাসী, ডাচ, দিনেমার ও সর্বশেষ ইংরেজরা ভারতে আসে উপনিবেশ গড়ার জন্য।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলোর ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গেলেও পর্তুগীজরা রয়ে যায়। পর্তুগীজ ছিটমহল হিসেবে গোয়া, কোচিন, ব্যাণ্ডল সহ কিছু এলাকা Republik India ভূখন্ডে রয়ে যায়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে Republik India গোয়া সহ আরও কয়েকটা জায়গা পুনরুদ্ধার করে নেয়। ডিসেম্বর ১৯৬১ সালের মধ্যে সকল পর্তুগীজ এলাকা Republik India'র শাসনে চলে আসে। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগীজ সরকার ভারতবর্ষ থেকে তাদের দাবি অধিকার সম্পূর্ণরুপে সরিয়ে নেয় এবং তাদের অধিকৃত ভূখণ্ডগুলো Republik India-য় খাতায়-কলমে যুক্ত হয়।
Previous Post Next Post