|| Manik Bandyopadhyay || মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ||
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় |
রবীন্দ্র ও শরৎ পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যের গতি পরিবর্তনে যে তিনজন সাহিত্যিকের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয় তাঁদের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম।
জন্ম ও শৈশব
জন্ম ১৯০৮ সালের ১৯শে মেবিহারের সাঁওতালপরগণার (অধুনা ঝাড়খণ্ডের) দুমকা জেলায়। হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীরদা সুন্দরী দেবীর পুত্র মানিকের আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্মের পর পঞ্জিকা অনুসারে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র। তবে পিতা রেখেছিলেন প্রবোধকুমার। আর ডাকনাম ছিল মানিক। ১৪ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্টার। পিতার চাকরির সুবাদে মানিকের শৈশব-কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল শহরে। তাঁর মা নীরদাসুন্দরীর আদি নিবাস ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি তিনি রচনা করেন তার প্রসিদ্ধ উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা’য়।
ছাত্র ও কর্ম জীবন
১৯২৬ সালে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে ১৯২৮ সালে বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে আই.এস.সি তে উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে অনার্সে ভর্তি হন।
সাহিত্যজগতে তাঁর আবির্ভাব একপ্রকার ধূমকেতুর ন্যায় বলা যেতে পারে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মূহুর্তে বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন লেখকের হাতে সাহিত্যজগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয়, মানিক ছিলেন তাদেরঅন্যতম।কলেজে ক্যান্টিনে এক বন্ধুর সাথে বাজী ধরেন যে তিনি তৎকালীন প্রচলিত বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপবেন এবং প্রবোধকুমার থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে লিখে ফেলেন 'অতসীমামী'। এর চার মাস পর বিচিত্রায় তা প্রকাশিত হলে পাঠক মহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাহিত্যজগতে প্রবেশ তাঁর অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারে থাবা বসালে শেষমেশ সাহিত্যরচনাকেই তিনি পেশা হিসাবে বেছে নেন।
ছাত্র, কর্ম জীবন ও সাহিত্য রচনা
দেহে ও মনে বলিষ্ঠ মানিক তাঁর সাহিত্যের পটভূমিতেও এনেছেন অসম্ভব বলিষ্ঠতা। বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছাঁচে না ঢেলে তিনি তাঁর সাহিত্যের শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত করেছেন রক্তের উত্তাপ। মূলত মার্কসবাদে বিশ্বাসী মানিক তাঁর গল্পে বা উপন্যাসে বস্তুবাদ ও ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। তাঁর একশ্রেণীর উপন্যাসে বিশাল নদীপ্রান্তরে সাধারণ মানুষের বাস্তবনিষ্ঠ জীবন যেমন রয়েছে, তেমনি মানুষের কামপিপাসার এক জীবন্ত মূর্তি এঁকে তিনি আদিম পৃথিবীর অন্ধকারময়তাকে অসামান্যভাবে উপস্থাপন করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। তাঁর অদ্ভুত নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণিত নরনারীর জৈবসত্তা, মনোবিকলনের বেআব্রু বিবরণ তৎকালীন কলকাতাকে খানিকটা চমকে দেয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পের পটভূমি মূলত দুই বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল। এই সময় লেখক খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন মধ্যবিত্ত সংকীর্ণতা ও কৃত্রিমতাজনিত স্বপ্নভঙ্গ, নিঃসঙ্গতাবোধ ও হতাশা যা মানুষকে বিকারগ্রস্ত করে তোলে। তাঁর গল্প মানুষকে সেই হতাশা, সেই বিকার থেকে মুক্তির পথে চালিত করে।নৈরাশ্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জীবনের স্রোতে ফেরানোর কাহিনী রচনা করেছেন 'আত্মহত্যার অধিকার' গল্পে। মানুষের জীবনসংগ্রামের মধ্যেও আদিম যে কামনা-বাসনার চিত্র লেখক 'ভিখু', 'পাঁচী' ও 'বসির মিঞা' চরিত্রের মধ্যে দেখিয়েছেন তা 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পসংকলনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করায়। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মুহূর্তে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় মানিকের সমাজ সচেতনতা নির্ভর গল্পগুলি অন্য মানের শিল্পসৃষ্টি। তেলেঙ্গানা ও তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা 'ছোট বকুলপুরের যাত্রী' ভাষার ইঙ্গিতময়তা ও জীবনবোধের কৌশলে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।
কথাসাহিত্যিক মানিকের ছোটগল্প দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও তিনি কিছু কবিতাও লিখেছেন। তাঁর রচিত পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্পসংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা নীরদা দেবীর আদিবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামের জীবনযাত্রার ধরন, মানুষের লোকায়ত জীবনের দলিল 'পুতুলনাচের ইতিকথা'।
উপন্যাস ও ছোটগল্প
পিতার বদলির চাকরীর জন্য মানিক ভ্রমণ করেছেন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। ফলত তিনি বাংলার প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং সেইসঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলার গ্রাম্যজীবনের সাদাকালো দিকগুলি। পূর্ববঙ্গের পদ্মানদীর তীরের একটি জেলেপাড়ার জীবনযাত্রার ওপর রচিত হয়েছে 'পদ্মানদীর মাঝি'। দরিদ্র জেদে কুবেরের জীবনকাহিনী, স্ত্রী মালা ও শ্যালিকা কপিলাকে কেন্দ্র করে কুবেরের জীবনের টানাপোড়েন ও দারিদ্র্যের সংঘাত চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে।
উপন্যাস বা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এক অন্যধারার সৃষ্টি করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে শেষজীবনে নিজেই সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সাহিত্যে দেখা যায় সেই প্রভাব। অবশ্য সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত মত ছিল যেটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা বিতর্ক সুবিদিত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন শিল্পী যিনি কলম হাতে মুখোশ রচনা না করে মুখোশের আড়ালে থাকা কৃত্রিম সুবিধাবাদী মুখকেই উন্মোচিত করেছেন তাঁর শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। আর এখানেই রবীন্দ্র তথা শরতোত্তর যুগে মানিকের জনপ্রিয়তা। ইংরেজি ছাড়াও তাঁর রচনাসমূহ বহু বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই কথা সাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।